গল্প- রক্তের দাম

রক্তের দাম
-অঞ্জনা গোড়িয়া

 

 

স্বপ্ন দেখে ছিল টিয়া। ভাবতে শিখে ছিল টিয়া। সে অনেক বড়ো হবে। অনেক কিছু শিখবে।
যখনি তাকে জিজ্ঞাসা করতাম, কি রে টিয়া তুই বড়ো হয়ে কী হতে চাস?
মিষ্টি হেসে বলতো, কী আবার হবো? আমি তো ডাক্তার হতে চাই। কত মানুষের অসুখ সারিয়ে দেব। কারোর কোনো কষ্ট থাকবে না। আর-একটু বড়ো হই। অনেক পড়াশোনা করতে হবে। তারপর একদিন পড়তে পড়তে ডাক্তার হয়ে ফিরে আসব। কি গো মা আমায় পড়াবে তো ডাক্তারী? মেয়েকে আড়াল করে আঁচলের খুঁটে চোখের জল মুছে নিল বিমলা। টিয়ার মা।
মেয়েকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে বললো, হ্যাঁ রে মা তোকে ডাক্তারী পড়াবো। আমাদের তো এত টাকা নেই। তোকে ভালো করে পড়তে হবে। সরকারি স্কলারশিপ পেতে হবে। তবেই না ডাক্তার হতে পারবি।
টিয়া হাসতে হাসতে বলল, আমি তো মন দিয়ে পড়ি মা। কিন্তু মাঝে মাঝে কেমন দূর্বল হয়ে যাই। গায়ে বল থাকে না। কিচ্ছু ভাল্লাগেনা তখন। ঠিক তখনই তুমি আমায় হসপিটালে নিয়ে যাও। আবার ছুটোছুটি করে রক্ত যোগাড় করো। আমার জন্য। আমাকে রক্ত দিলে তবে আমি সুস্থ হই।
কেন মা আমাকে রক্ত দিতে হয়?
আমার বড্ড কষ্ট হয়। কবে সুস্থ হবো? আর সবার মতো। কবে সবার সঙ্গে খেলাধূলা করবো? মন দিয়ে বই পড়বো? স্কুলে যেতে ক্লান্ত লাগবে না। বলো না মা আর কত দিন পর আমি ভালো হবো?
মায়ের আশ্বাস বাণী, আর কয়েকটা মাস পরেই সুস্থ হয়ে যাবি সোনা।

দিন যায় মাস যায়। ক্রমশ ঝিমিয়ে যাচ্ছে ছোট্ট টিয়া। মায়ের শেষ সম্বল হাতের চুড়ি দুটো বন্ধক রেখেছে পাড়ার সেকরার দোকানে। তবু সমস্ত ব্লাডব্যাংক ঘুরে ঘুরেও টিয়ার গ্রুপের রক্ত পাওয়া গেল না।
পাগলের মতো ছুটোছুটি করে চলেছে মা।
এখনো চলছে লকডাউন। করোনা পরিস্থিতিতে সমস্ত ব্লাডব্যাংকে রক্তের আকাল। ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্প সেভাবে হয় নি। তাই রক্তের চাহিদা বাড়ছে।
যদি এক বোতল রক্ত দেওয়া হয় তবেই অন্য গ্রুপের রক্ত পাওয়া যাবে। টিয়ার মা পাড়ায় জনে জনে হাতে ধরে অনুরোধ করেছে। যদি কেউ এক বোতল রক্ত দান করে। কারোর সাড়া পেল না।
টিয়া এখন হসপিটালে ভর্তি। ঈশ্বরের পায়ে মাথা ঠুকে প্রার্থনা জানায়, বাঁচিয়ে দাও। আমার মেয়েকে বাঁচিয়ে দাও। ওর যে অনেক স্বপ্ন। ডাক্তার হবার স্বপ্ন। বড়ো হবার স্বপ্ন। কী করে বাঁচাবো টিয়াকে?

নার্স ছুটতে ছুটতে এসে জানালো আপনার মেয়ে আপনাকে দেখতে চেয়েছে।
কী হয়েছে আমার মেয়ের? ভালো আছে তো? বিমলা উত্তর শোনার অপেক্ষা না করেই কাঁদতে কাঁদতে অসহায়ের মতো ছুটে গেল কেবিনের দিকে।

বুক ভরা হাসিতে কাছে ডেকে নিল মেয়ে। “আমি ভালো আছি মা”।
মা অবাক হয়ে তাকিয়ে মেয়ের দিকে। কী করে সম্ভব হলো? কে দিল রক্ত ?
ডাক্তারবাবু এসে জানালেন, পাশের কেবিনে শুয়ে থাকা ব্যাক্তির দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন, এই সমস্ত রক্তদাতা ভাই-বোনেদের জন্য এখনো থ্যালাসেমিয়া রোগীরা বেঁচে আছে। সুস্থ আছে। ইনি করিম ভাই। আপনার মেয়েকে রক্ত দিয়েছে। আজ তাই টিয়া ভালো আছে।
টিয়ার মা হাতজোড় আশীর্বাদ করে বলে, এভাবেই তুমি সবার পাশে থেকো। রক্ত দিয়ে সবাইকে সুস্থ রেখো।
আজ থেকে তুমি আমার সন্তান। টিয়ার বড়ো দাদা হয়ে থেকো।

Loading

Leave A Comment